আজ ৯ডিসেম্বর, ত্রিশাল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ভোরের সূর্য উদয়ের সাথে সাথে মুক্ত আকাশে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলেন ত্রিশালের মুক্তিকামী জনতা। এই দিনেই স্মরণকালের ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিজয় মিছিল নিয়ে অগ্নিদীপ্ত উল্লাসে বিজয়ের আনন্দে মেতেউঠে ছিল ত্রিশালবাসী। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বরের দৃশ্যপট ছিল এমনটাই ।
বীর মুক্তিযুদ্ধা এডভোকেট আবুল মনসুর আহামেদ এম.পি.এ(এফ.এফ-৯৩২৩) ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন । ৭০ – এর নির্বাচনে তিনি ত্রিশাল থেকে । আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এম.পি.এ নির্বাচিত হন । বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পর সারাদেশের মতো ত্রিশালের সাধারণ মানুষও স্বাধীনতার জন্য মুক্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে ছিল। প্রায় প্রতিদিন মিছিল মিটিং হতো। আবুল মনসুর আহাম্মেদ সেই মিটিং মিছিল পরিচালনা করতেন । তার নেতৃত্বে মিছিলকারীরা দা ছল বল্লম নিয়ে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত মুভ করেছে । তিনি একটি ৮০ মটরসাইকেল নিয়ে ত্রিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতেন । মটরসাইকেল চালিয়ে ময়মনসিংহ আসা যাওয়া করতেন । বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে ত্রিশালের নজরুল একাডেমী মাঠ , ধানীখোলা হাইস্কুল মাঠ , কাজীর শিমলা নজরুল উচ্চবিদ্যালয় মাঠ , কালীর বাজার হাইস্কুল মাঠ প্রভৃতি জায়গায় তখন ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয় । এসব ট্রেনিং সেন্টার চালু করার ক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহাম্মেদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন । তার সহযোদ্ধা দের মধ্যে ছিলেন ত্রিশাল ফুলবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত এমএনএ অধ্যাপক এনএম নজরুল ইসলাম । প্রবীণ নেতা ও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি জৈমত আলী সরকার , আ:সালাম তরফদার তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুল আলম প্রমুখ । ২৩ এপ্রিল পাকবাহিনী ময়মনসিংহ শহর দখল করে । আনুমানিক ৪-৫ দিন পর পাকবাহিনী ত্রিশালে আসে । আবুল মনসুর আহাম্মেদ সম্ভবত এপ্রিল মাসের ১৮-১৯ তারিখ ভারতের মেঘালয়ে চলে যায় । তিনি ভারত যাওয়ার পথে রফিকউদ্দিন ভুইয়া , শামসুল হক এমপিএ রামচন্দ্রপুর মোশারফ আকন্দের বাড়ি যান । পরে তারা ফুলপুর হালুয়াঘাট হয়ে ভারতের তুরায় যান । তিনি মূলত তুরা জেলার সংসনগিরীতে গিয়ে ওঠেন । সংসনগিরীর অবস্থান ছিল ডালু থানার নিকটবর্তী একটি জায়গা । যেখানে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । ডালুতে অবস্থানকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের অনেক সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ও পরিণতি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন । সেই সময় খন্দকার আ . মালেক শহীদুল্লাহ ,শামসুল হক , আবুল মনসুর আহাম্মেদ ,আবুল হাশেমসহ হাতে গোনা কয়েকজন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন । তারা ময়মনসিংহের জননেতা রফিকউদ্দিন ভূইয়ার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ করেন । তার নেতৃত্বে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ় ভূমিকা রাখেন । শুধু তাই নয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের মাত্র ৩ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধের ভারতের সশস্ত্র ট্রেনিং ( F.F ) গ্রহণ করেন । আবুল মনসুর আহাম্মেদ তাদের একজন ।তিনি দেরাদুনে B.L.F ট্রেনিং নিয়েছিলেন যাহার নাম্বার-৯৩২৩। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ গ্রন্থে এইচটি ইমাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে আলোচনা করতে যেয়ে বলেন , ‘ এছাড়া যেসব প্রতিনিধি বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশ গ্রহণ করেছেন তাদের নামও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় । সেই তালিকায় তিনি অনেকের মধ্যে সৈয়দ আবদুস সুলতান ও জনাব আবুল মনসুর আহাম্মেদএর নাম উল্লেখ করেছেন । আবুল মনসুর আহাম্মেদ ১১ নং সেক্টরের চিফ এডমিনিস্ট্রেটর ও প্রচার সম্পাদক ছিলেন । তিনি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক রণাঙ্গণ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন । মেঘালয়ের তুরা জেলায় মুক্তিফৌজের যে প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়েছিল সেখানে লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এডভোকেট মোশারফ হোসেন আকন্দ এমএনএ । প্রধান প্রশাসক ছিলেন আবুল মনসুর আহাম্মেদ এম.পি.এ । ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে ভারতের মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে ভালু থেকে হালয়াঘাটের পাকবাহিনীর সুরক্ষিত ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ করেন । ভারতীয় মিত্র বাহিনীর পক্ষে বিগ্রেডিয়ার সান সিং বাবাজী ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে জয়বাংলা বাহিনীর প্রধান আবুল হাশেম , সুবেদার জিয়াউল হক সহ অন্তত ৩০ জন এফ এফ কমান্ডার এই আক্রমণের সাথে যুক্ত হন দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া ১১ নম্বর সেক্টরের এফজে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে ময়মনসিংহ অঞ্চলে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওই দিনই ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিংয়ের অধীনে বেশ কয়েকটি মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি জেলার সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর একের পর এক আক্রমণের পাশাপাশি আকাশ যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের বাংকারগুলো লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এতে হানাদার বাহিনী পিছু হঠতে শুরু করে।
পরদিন ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ভারতীয় সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট শত্রুমুক্ত করে। এতে হানাদার বাহিনী আরও পিছু হটে পাশ্ববর্তী ফুলপুর, তারাকান্দা ও ময়মনসিংহ সদরের শম্ভুগঞ্জ এসে জড়ো হতে শুরু করে তাদের সমন্বিত আক্রমণে ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে হালুয়াঘাট পাক হানাদার মুক্ত হয় ।
হানাদার বাহিনী যুদ্ধের কৌশল হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা স্থল পথে যাতে তাদের কাছে না আসতে পারে সেজন্য ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়কের ব্রিজ ও কালভার্টগুলোতে মাইন পুঁতে রাখে। কিন্তু তাদের এমন রণকৌশল সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা অতি সাবধানতা অবলম্বন করে স্থল পথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আস্তানার দিকে এগুতে শুরু করে এবং অত্যন্ত সফলভাবে তাদের ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হন।
৮ ডিসেম্বর রাতে মেজর আফসার বাহিনীর যুদ্ধ কালীন কমান্ডার আনসার উদ্দিনও আব্দুল বারীর নেতৃত্বে গভীর রাতে সুতিয়া নদীর পাড়ে অবস্থতি ত্রিশাল থানায় মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করে। ভোর পর্যন্ত গুলি বিনিময় শেষে রাজাকাররা আত্বসমর্পন করেন এবং কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে যায়।এ সময় ১০ রাজাকারকে আটক করতে সক্ষম হয় মুক্তিবাহিনী। সে দিন কুয়াশা চাদর ঘেরা ভোরে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে ত্রিশালের মুক্তিকামী জনতার। সকালে মুক্তি যোদ্ধের সংগঠক ও তৎকালীন ত্রিশাল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জৈমত আলী ৯ই ডিসেম্বর সকালে স্থানীয় নজরুল একাডেমী মাঠে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন।
তথ্য সূত্র : ১. ব্রহ্মপুত্র তীরে সূর্যোদয় , ২. সাক্ষাৎকার : কামাল পাশা , ৩ . সাক্ষাৎকার : খন্দকার আ . মালেক , ৪. বিজয় : নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত স্মরণিকা , ৫. বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ : এইচটি ইমাম
Leave a Reply